x
- ডাক্তার মোঃ আব্দুল মতিন
এম.বি.বি.এস, সি.এম.ইউ; এম.সি.পি.এস (ল্যাব মেডিসিন)
• থ্যালাসেমিয়া: World Thalassaemia Day was first observed on May 8, 1994, in memory of TIF President Panos Englezos' son, George, who battled the disease
থ্যালাসেমিয়া এক ধরনের বংশগত রক্তরোগ।
প্রতি বছর ৮ মে পালিত হয় বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। এ বছরের থিম হলো-‘Empowering Lives, Embracing Progress: Equitable and Accessible Thalassaemia Treatment for All’।
বিশ্বের কোথাও না কোথাও অহরহ বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট চলছে৷ আবার জিন থেরাপিও চলছে কোথাও কোথাও আর কোথাও চলছে শুধুই রক্ত পরিসঞ্চালন। আয়রন চিলেশনের ওষুধটিও সহজলভ্য না। এমন অসাম্য দূর করতেই এবারের প্রতিপাদ্যটি গ্রহণ করা হয়েছে। সবার জন্য সমতাভিত্তিক, সহজলভ্য থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসা নিশ্চিত করাই হোক আমাদের লক্ষ্য।
• থ্যালাসেমিয়া কি?
থ্যালাসেমিয়া এক ধরনের বংশগত রক্তরোগ। যা বংশ পরম্পরায় জিনের মাধ্যমে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে পরিবাহিত হয়।
• থ্যালাসেমিয়াতে কি হয়?
আমাদের রক্তে তিন ধরণের কণিকা থাকে। তন্মধ্যে লোহিত রক্তকণিকা একটি। সেখানে হিমোগ্লোবিন নামে বিশেষ ধরনের রঞ্জক পদার্থ থাকে। এই হিমোগ্লোবিনের কাজ হলো শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন সরবরাহ করা।
হিমোগ্লোবিন তৈরি হয় আলফা চেইন ও বিটা চেইন নামক দুরকম চেইনের সমন্বয়ে। এর কোনটাতে সমস্যা হলে হিমোগ্লোবিনের উৎপাদন বিঘ্ন ঘটে। এতে তৈরি হয় ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লেবিন। স্বাভাবিক লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল ১২০ দিন। ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিনের কারণে লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল কমে যায় এবং লোহিত কণিকাগুলো সহজেই ভেঙে যায়। এ অবস্থায় শরীরে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। সেখান থেকে দেখা দেয় নানা রকম উপসর্গ। এই হলো থ্যালাসেমিয়া। রক্তপাত সহজে বন্ধ হয় না এই রোগে।
• থ্যালাসেমিয়া কয় ধরনের?
থ্যালাসেমিয়া অনেক রকমের আছে। সহজ করে বলা যায় থ্যালাসেমিয়া প্রধাণত দুই প্রকার—আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বিটা থ্যালাসেমিয়া।
বিশ্বে বিটা থ্যালাসেমিয়ার প্রাদুর্ভাব আলফা থ্যালাসেমিয়ার তুলনায় বেশি। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আলফা থ্যালাসেমিয়া তীব্র হয় না। অনেক ক্ষেত্রে এর উপসর্গও বোঝা যায় না, রোগী স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করে।
রোগীর তীব্রতা এবং রক্তপরিসঞ্চালনের উপর নির্ভরতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় থ্যালাসেমিয়া প্রকার। একটি বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর। এদের থ্যালসেমিয়া ট্রেইট বা ক্যারিয়ার বলে। অপরটি থ্যালাসেমিয়া মেজর। থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট মূলত রোগটির বাহক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এদের শরীরে থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায় না। অনেকে হয়তো অজান্তেই সারাজীবন এই রোগ বহন করে চলে। অল্প কিছু ক্ষেত্রে মৃদু রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। বাবা ও মা উভয়েই থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট হলে শিশুর থ্যালাসেমিয়া মেজরে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে শতকরা ২৫ ভাগ। ক্যারিয়ার হবার সম্ভাবনা থাকে শতকরা ৫০ ভাগ৷
• উপসর্গ:
থ্যালাসেমিয়ার উপসর্গগুলো মূলত রক্তস্বল্পতাজনিত উপসর্গ। অর্থাৎ ক্লান্তি, অবসাদগ্রস্ততা, শ্বাসকষ্ট, ত্বক ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া এসব। রক্ত অধিক হারে ভেঙে যায় বলে জন্ডিস হয়ে ত্বক হলদে হয়ে যায়। প্রস্রাবও হলুদ হতে পারে। প্লীহা বড় হয়ে যায়। যকৃতও বড় হয়ে যেতে পারে। অস্থি পাতলা হয়ে যেতে থাকে। চেহারার বিশেষ পরিবর্তন হয়। নাকের হাড় দেবে যায়। মুখের গড়ন হয় চীনাদের মতো। একে বলে ‘মংগোলয়েড ফেইস’। শরীরের বৃদ্ধি কমে যায়। আস্তে আস্তে দেখা দেয় বিশেষ কিছু জটিলতা।
রোগীকে ঘনঘন রক্ত দিতে হয় বলে শরীরে আয়রনের মাত্রা বাড়তে থাকে। এই আয়রন জমা হয় হৃৎপিণ্ডে, যকৃতে, অগ্ন্যাশয়ে। এই পর্যায়টি মারাত্মক। দেখা যায়, অতিরিক্ত আয়রন জমে যাওয়ার কারেণে অঙ্গগুলো বিকল হতে শুরু করে। এ রকম পরিস্থিতিতে সঠিক চিকিৎসা না পেলে রোগী মারা যেতে পারে। বারবার রক্ত পরিসঞ্চালনের কারণে রোগীরা সহজেই রক্তবাহিত সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
• পরীক্ষা-নিরীক্ষা:
থ্যালাসেমিয়া শনাক্ত করার সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতিটি হচ্ছে রক্তের হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস পরীক্ষা। রক্তের রুটিন পরীক্ষা (সিবিসি) থেকে থ্যালাসেমিয়ার সম্ভাবনা আঁচ করা যায়। রক্তস্বল্পতা ছাড়াও এই রোগে লোহিত কণিকার আকার ছোট হয়ে যায়। রুটিন পরীক্ষায় সেটা বোঝা যায়। এ ছাড়া ডিএনএ পরীক্ষা করেও এই রোগ ধরা যায়। মাথার এক্স-রে, পেটের আলট্রাসনোগ্রাম ও সহায়ক পরীক্ষা।
• চিকিৎসা:
রক্ত পরিসঞ্চালনই থ্যালাসেমিয়ার মূল চিকিৎসা। আয়রন বেড়ে গেলে আয়রন চিলেশনের ওষুধ দিয়ে তা কমাতে হয়। প্লীহা অতিরিক্ত বড় হয়ে গেলে অপারেশন করে সেটা ছোট করে দিতে হয়। এতে রক্ত গ্রহণের হার কিছুটা কমে আসে। মূলত অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন (বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট) হলো এর স্থায়ী চিকিৎসা। জিন থেরাপিও এই রোগের আরেকটি উন্নত চিকিৎসা৷
• পরিসংখ্যান:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার(WHO) মতে, সারা বিশ্বে প্রায় ১০ কোটির বেশি লোক বিভিন্ন ধরণের বিটা থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করে। প্রতিবছর প্রায় এক লাখ শিশু জটিল থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার(WHO) হিসাব মতে, বাংলাদেশে ৪৮ লাখ মানুষ থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করছে। ৩ শতাংশ লোক বিটা থ্যালাসেমিয়ার বাহক, ৪ শতাংশ অন্যান্য ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন রোগের বাহক। প্রতি বছর ছয় হাজার শিশু বিভিন্ন রকমের থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে।
• প্রতিরোধে করণীয়:
থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে সচেতন হওয়া মূখ্য। বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করে থ্যালাসেমিয়া অনেকখানি কমানো যেতে পারে। দুজন ক্যারিয়ারের মধ্যে যেন বিয়ে না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে পারলে থ্যালাসেমিয়া কমানো সম্ভব।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন