বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কিভাবে ভালো রেজাল্ট করব?
হাসান (ছদ্মনাম) এবার বাংলাদেশের নামকরা একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। বাবা- মা, আত্মীয়- স্বজন, পাড়া- প্রতিবেশীদের অভ্যর্থনায় বেশ ভালো সময় কাটছিল তার। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু হয়ে গেলো। সেও নিয়মিত ক্লাস করতো, ক্লাস শেষে আড্ডা, খেলাধুলা, সোস্যাল নেটওয়ার্কিং ইত্যাদিতে সময় কাটাতো। এভাবেই তার সেমিস্টার শেষ হয়ে গেলো। কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল করতে ব্যর্থ হল। হাসান কোনভাবেই এর ব্যাখ্যা খুঁজে পেলো না।
হাসানের মত এবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী চান্স পেয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু অনেক শিক্ষার্থী বুঝতে পারেনা কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে ভালো একটি ফলাফল করতে হয়। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে স্কুল কলেজে তারা অন্যভাবে পড়াশুনা করে এসেছে। স্কুল কলেজে নিয়মিত ক্লাস করলেও প্রতিটি শিক্ষার্থী কোচিং, প্রাইভেট বা গৃহশিক্ষকের সাহায্য নিয়ে তার প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনাটা একদমই ভিন্ন। এখানে কোচিং, প্রাইভেট বা গৃহশিক্ষকের কোন অস্তিত্ব নেই। সমস্ত পড়াশুনা ক্লাসেই পড়ানো হয়ে থাকে। তাই শিক্ষার্থীরা যেহেতু ইতিপূর্বে স্কুল কলেজে ক্লাসে মনোযোগী না থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও একই কাজ করে যার ফলাফল হয় অত্যন্ত ভয়াবহ। তাহলে কিভাবে লেভেলের পড়াশুনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফলাফল করা সম্ভব?
প্রথমেই বলে নিই, বিশ্ববিদ্যালয় মানেই সারাদিন পড়াশোনা করতে হবে, পড়াশুনার বাইরে আর কোন জগৎ নেই, এমন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা করবে, বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা দিবে, ট্যুরে যাবে, বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবে। তবে সবার আগে নিজের পড়াশুনা ঠিক রেখে। কারণ ভালো করে পড়াশুনা করে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলাই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য অর্জনে নিচের পন্থাগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে-
১. ক্লাসে পুরোপুরি মনোযোগী থাকা: শ্রেণীকক্ষের ক্লাসই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার মাধ্যম। তাই ক্লাসের পুরোটা সময় মনোযোগী থাকা অত্যন্ত জরুরি। আর ক্লাসে মনোযোগী থাকার কয়েকটি টিপস হল – ক্লাসে সামনের সাড়িতে বসা, ক্লাস নোট লেখার অভ্যাস করা, আগের রাতে ভালোমত ঘুমিয়ে আসা, শিক্ষক কি পড়াবেন সেটা আগে থেকে জন্য থাকলে ওই ব্যাপারে একটু পড়াশুনা করে আসা। এর মধ্যে ক্লাসে নোট তোলাটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যখন একজন শিক্ষার্থী ক্লাসে নোট তুলতে চাইবে তাকে অবশ্যই শিক্ষকের কথা মনোযোগ সহকারে শুনতে হবে। দেখা গিয়েছে যারা সামনের দিকে বসে এবং ক্লাসে নোট তোলে তারাই ফাইনাল পরীক্ষায় ও অন্যান্য পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে থাকে। আর ক্লাস উপস্থিতির মার্কস ফাইনাল পরীক্ষায় যোগ হয়।
২. বাসায় এসে ক্লাসনোট দেখা: ক্লাসে যে নোট তোলা হয়েছে বাসায় এসে অল্প সময়ের জন্য হলেও সেই নোট দেখতে হবে কারণ ক্লাসে যদি একটি লেকচার ভালোমতো শোনা হয়, সেটি নোট করা হয় এবং বাসায় এসে অল্প সময় দেখা হয় তাহলে সে পড়াটি অবশ্যই মস্তিষ্কে গেঁথে যাবে। এভাবে প্রতিদিনের পড়া যদি প্রতিদিন অল্প সময়ের মধ্যে পড়ে ফেলা হয় তাহলে পরীক্ষার আগে এসে আর অতিরিক্ত চাপ পড়বে না ফলে তার রিভিশন দেওয়া এবং ভালোভাবে প্রস্তুতি নেওয়া খুব সহজ হবে।
৩. গ্রুপ স্টাডি করা: যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় একটি ক্লাস সাধারণত আর রিপিট করা হয় না তাই ক্লাসে যদি কোন কিছু বুঝতে অসুবিধা থাকে তাহলে বন্ধুবান্ধবের সাথে গ্রুপ স্টাডি করা এবং গ্রুপ স্টাডির সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন পড়াশোনা সম্পর্কে বেশি আলোচনা হয় কারণ সাধারণত দেখা যায় অনেক সময় গ্রুপ স্টাডি করতে গেলে পড়াশোনার চেয়ে গল্প গুজব বেশি হয়।
৪. ইন্টারনেটের সাহায্য নেওয়া: বর্তমানে সকল বিষয়ের পড়াশোনার ম্যাটেরিয়ালস ইন্টারনেটে সহজলভ্য। তাই যদি কোন বিষয়ে পড়ার সময় বুঝতে অসুবিধা থাকে সে সম্পর্কে ইউটিউবে কিংবা গুগলে সাহায্য নেয়া যেতে পারে। তবে ইন্টারনেট ব্যবহার করার সময় অবশ্যই সচেতন হতে হবে যেন বেশি সময় ইন্টারনেটে অপচয় না হয়।
৫. সময়ের অপচয় রোধ করা: কথায় বলে "সময়ের এক ফোড়ন অসময়ের দশ ফোড়ন"। তাই, বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনে সময়কে খুব বেশি কাজে লাগানো উচিত। সোশ্যাল মিডিয়া, ভিডিও গেমস, মুভি, অতিরিক্ত গল্প আড্ডা ইত্যাদিতে যেন বেশি সময় অপচয় না হয় সে ব্যাপার খুবই সতর্ক থাকা।
৬. অতিরিক্ত টিউশনি থেকে নিজেকে বাঁচানো: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে অতিরিক্ত টিউশনি করানোর একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যদি কারো পরিবারে আর্থিকভাবে সমস্যা থাকে সে একটি বা দুটি টিউশনি করে নিজের খরচ চালাতে পারে কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত টিউশনি করানোর কারণে নিজের পড়াশোনাতে ক্ষতি হয়। প্রয়োজন না থাকলে এসব থেকে বিরত থাকা উচিত।
৬. পরীক্ষার আগে খুব বেশি সতর্ক থাকা: যেহেতু পরীক্ষার মাধ্যমেই একজন শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করা হয়, তাই প্রতিটি পরীক্ষার আগে অনেক যত্নশীল থাকা উচিত । সেটি যেই পরীক্ষা হোক না কেন । কোন পরীক্ষাকেই হেঁয়ালি ভাবে নেওয়া যাবে না।
এভাবে যদি কোন শিক্ষার্থী নিয়মিত পড়াশোনা করে, পাশাপাশি অন্যান্য সামাজিক কাজেও জড়িত থাকে তবুও তার রেজাল্ট আশানুরূপ হবে বলে মনে করা যায়। আর একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয় হলো যে, অনেকেই বলে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজাল্ট কোন ব্যাপার না। এসব কথায় একদম কান দেওয়া যাবে না। একটি কথা সমাজে প্রচলিত আছে, "আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী"। যেকোন চাকরির পরীক্ষার শুধু রেজাল্ট দেখেই বেশিরভাগ প্রার্থীকে বাদ দেওয়া হয়। আর কোন প্রার্থীর রেজাল্ট ভালো থাকলে প্রথমেই তার সম্পর্কে একটি ভালো ধারণা তৈরি হয় নির্বাচকদের মনে। তাই রেজাল্ট ভালো রাখা কোনো দিক দিয়েই খারাপ নয়। আশা করি, এই পরামর্শগুলো অনুসরণ করে তারা তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনকে সাফল্যমন্ডিত করবে এবং পাশাপাশি দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কান্ডারী হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলবে।
লেখক: মো. আব্দুস সবুর
প্রভাষক, লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উপদেষ্টা, নওগাঁ ইয়ুথ ক্লাব
abdusshabur@du.ac.bd
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন